রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর জুলাই সনদের যে খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে তা সংশোধনের সুযোগ থাকবে না বলে জানিয়েছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলাকে তিনি এ কথা জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অনুষ্ঠানের দিন কোনো দল সনদে স্বাক্ষর না করলেও পরে স্বাক্ষর করতে পারবে। তিনি বক্তব্যে অনড় থাকতে পারেননি। শুক্রবার জুলাই যোদ্ধাদের ব্যানারে সংসদ ভবন এলাকায় অগ্নিসংযোগ, পুলিশের লাঠিচার্জ, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে জুলাই সনদের অঙ্গীকারনামায় সংশোধন আনে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন। যে দফায় আগে শুধু ‘জুলাই শহীদদের’ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও সহায়তার বিষয় ছিল, সেখানে এখন আহতদের জন্যও মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সংশোধিত দফাটিতে আগে বলা ছিল, “গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করব।”
সংশোধিত দফায় বলা হচ্ছে “গণ-অভ্যুত্থানপূর্ব বাংলাদেশে ১৬ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান কালে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারকে এবং জুলাই আহতদের রাষ্ট্রীয় বীর, আহত জুলাই বীর যোদ্ধাদের যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান যেমন মাসিক ভাতা, সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ব্যবস্থা এবং শহীদ পরিবার ও আহত বীর যোদ্ধাদের আইনগত দায়মুক্তি, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবো।”
শুক্রবার বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে ক্ষমা চেয়ে ঐক্যমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন “আজ আপনাদের এভাবে দেখা করতে হচ্ছে, সেটা আমাদের জন্য শুধু লজ্জা, ক্ষোভের, দুঃখের বিষয় না; আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় রকমের পরিস্থিতি কখনোই আমরা মনে করি না।” এরপর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে জরুরি সংশোধন আনার কথা জানানো হয়।
শেষ পর্যন্ত বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৫টি দলের নেতারা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করলেও এতে অংশ নেয়নি এবং স্বাক্ষর করেনি জাতীয় নাগরিক পার্টি ( এনসিপি), কমিউনিস্ট পার্টি, বাসদসহ চারটি বামপন্থী দল। সনদে স্বাক্ষর না করার বিষয়ে এনসিপি তিনটি দাবি জানিয়েছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে–এক, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আগেই প্রকাশ করতে হবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া “জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়” অনুসারে সরকার প্রধান হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন। জুলাই সনদের বৈধতার উৎস হতে হবে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। দুই, জুলাই সনদের ৮৪টি সংস্কারের বিষয়ে গণভোট হবে। এতে নোট অব ডিসেন্টের আলাদা কোনো কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের প্রশ্ন কী হবে তা আগেই চূড়ান্ত করতে হবে এবং তা রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখাতে হবে। এবং তিন, গণভোটের মাধ্যমে জনগণ যদি জুলাই সনদের পক্ষে রায় দেয়, তবে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ এর কোনো কার্যকরিতা থাকবে না; গণভোটের রায় অনুযায়ী আগামী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে সংবিধান সংস্কার করবে এবং সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬’। অন্যদিকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাসদ (মার্ক্সবাদী) ও বাংলাদেশ জাসদ জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি। তাদের দাবি , ইতিহাস ‘সঠিকভাবে না আসা’ এবং সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। এদিকে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেও তাতে সই করেনি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন দল গণফোরাম। সনদের চূড়ান্ত কপি হাতে পেতে দেরি হওয়ায় এবং তাদের নোট অফ ডিসেন্ট বা আপত্তি থাকা বিষয়গুলো সংশোধন হয়েছে কিনা, সেগুলো নিশ্চিত না হওয়ার কারণে তাৎক্ষণিক তারা স্বাক্ষর করেননি।
দীর্ঘ আলোচনার পর জুলাই সনদ স্বাক্ষর হলো। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই এসেছে জুলাই সনদ। আশা করা হচ্ছিল জুলাই অভ্যুত্থানে সংশ্লিষ্ট সব দল এখানে স্বতস্ফুর্তভাবে স্বাক্ষর দেবে। কিন্তু দেখা গেলো জুলাই অভ্যুত্থান থেকে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক এনসিপিই সনদে স্বাক্ষর করেনি। যা ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য সুখকর নয়। ওই অনুষ্ঠানে অন্য যে কোনো দলের চেয়ে এসসিপির উপস্থিতি কাম্য ছিল। এছাড়া অনুষ্ঠানের আগ মুহূর্তে জুলাই যোদ্ধাদের বিক্ষোভ এবং এর প্রেক্ষিতে সনদে আবারও পরিবর্তন ঐক্যমত্য কমিশনের ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই না। জুলাই অভ্যুত্থানের স্বীকৃতিতে আহতদের বিষয় থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল। তা না থাকাই বরং বিস্ময়ের বিষয়।
সনদ স্বাক্ষরের পর যাদের জন্য এই সনদ তারাই সনদে আরও কিছু বিষয় অর্ন্তভূক্ত করার দাবিতে আন্দোলনে যাবার কথা ভাবছে। ইতোমধ্যেে আহত জুলাই যোদ্ধারা রোববার সারাদেশের মহসড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে। তাদের তিন দফা দাবিগুলো হলো—জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের জাতীয় বীর হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং নির্যাতিত, আহত ও যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন, তাদের বীর হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে; শহীদ ও আহত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা এবং দায়মুক্তি দিয়ে সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। জুলাই যোদ্ধাদের এই দাবিগুলো এনসিপির তিন দাবির বর্ধিত অংশ। এখন এনসিপি ও জুলাই যোদ্ধাদের দাবি এক হলে ছয় দাবি বর্তমান সরকারের সামনে আসবে। যেটা আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এনসিপির সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তবু শঙ্কা তো থেকেই যায়। যদি ধরে নেই এনসিপি যে কারণে সনদে স্বাক্ষর করেনি, সেগুলো নির্বাচনের আগে পূরণ হলো না, তবে কি নির্বাচনে এনসিপি অংশ নেবে না? আশা করি তেমন কিছু ঘটবে না। খুব শিগগিরই এসব সমস্যার সমাধান হবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের স্বার্থে সমাধান জরুরি।
কেউ কেউ বলছে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হচ্ছে। যদিও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হবে বলে সুস্পষ্ট করেছেন। যারা বলছে নির্বাচন বিলম্বের চেষ্টা হচ্ছে তাদের কথার সূত্র নেই। এগুলো মূলত ধারণা নির্ভর কথা। তবে একথা সত্য যে সাধারণ মানুষের কাছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে এখনো সংশয় রয়েছে। পাড়া মহল্লার চায়ের কাপে আলোচনায় এ প্রশ্নটা ঘুরছে। এর কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান। সবাই নির্বাচন চাইছে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএনপি ছাড়া বর্তমানে বড় আলোচনার দল জামায়াত ও এনসিপি নির্বাচনের আগে তাদের দাবি পূরণের জন্য সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছে। একারণে সাধারণ জনগণ মনে করে সরকার এদুটি দলের দাবি পূরণ না করে নির্বাচনে যেতে পারবে না। আবার অন্যরা মনে করেন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেই সবাই নির্বাচনমুখী হবে।
তবে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য আগামী নির্বাচন ধীরে ধীরে কঠিন হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান নির্বাচনকে কঠিন করে তুলছে। তবে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে ভারত চলে যাওয়ার দেশের রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এ কারণে দ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা উচিত অন্তর্বর্তী সরকারের। উপদেষ্টাদের সেফ এক্সিট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এনসিপির নেতারা। যেটা আসলে কাম্য নয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশকে খাদের কিনারা থেকে তুলে এনেছে।
লেখক: সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক
zakpol74@gmail.com