এটা কী হামলা না দমনের চেষ্টা

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হককে মারধরের ছবি। ভিডিওগুলোতে দেখা যায় যারা তাকে পেটাচ্ছে নির্দয়ভাবে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। তিনি মারাত্মক আহত হবার পর হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। তার চিকিৎসায় উচ্চপর্যায়ের মেডিকেল বোর্ড গঠন করেছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আজ শনিবার সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান গণমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন, নুরুল হকের মাথায় আঘাত রয়েছে। তার নাকের হাড় ভেঙে গেছে। যে কারণে গতকাল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়েছিল । আগেই রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে ও জ্ঞান ফিরেছে। তবে ৪৮ ঘণ্টার আগে নুরুল হক আশঙ্কামুক্ত, সেটি বলা সম্ভব নয়।

এদিকে নুরুল হককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী লাঠিপেটা করার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেস উইং বিবৃতিতে গণমাধ্যমকে নিন্দা বিষয়টি জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা এবং গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও জনগণের অধিকার আদায়ের পক্ষে সাহসী ভূমিকা রাখা রাজনীতিবিদ নুরুল হকের ওপর নৃশংস হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। নুরের স্বাস্থ্যগত অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ফোনে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে নুরের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন এবং প্রয়োজনীয় সব ধরনের চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করার আশ্বাস দেন।  এগুলো সবই গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত খবর। নূরের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, এনসিপি , জামায়াতসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতারা। নূরের দল গণঅধিকার পরিষদের পক্ষ থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছে। যদিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এবিষয়ে কোনো বক্তব্য জানা যায়নি। তবে ওই হামলার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

প্রশ্ন হচ্ছে এধরণের পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন? রাজনৈতিক দলগুলো যে যার কর্মসূচি পালন করবে, এখানে বাধা দেওয়ার কিছু নেই , উসকানি দেওয়ার কিছু নেই। অথচ দেখা গেলো শুক্রবার কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গণঅধিকার পরিষদ ও জাপা নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হলো। সন্ধ্যা সোয়া ৬টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত এ সংঘর্ষ চলে। এ সময় উভয়পক্ষ একে অপরকে ধাওয়া দেয় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। জাতীয় পার্টির কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে গণ অধিকার পরিষদের কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। দুই দফা সংঘর্ষের পর অ্যাকশানে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।  জনমানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কখনো কখনো কঠোর হতেই হয়। কিন্তু ভিডিও ফুটেজে যেরকম দেখা যাচ্ছে সেরকম হতে হয় কি?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় নূরকে বেধরক পেটাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রশ্ন হচ্ছে কোটা আন্দোলন থেকে উঠে এলেও  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিপি হয়েছিলেন নূর। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। তারপরও তাকে সবাই ভিপি নূর হিসেবেই চেনেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ছাত্র লীগের হাতে এতবার তিনি মার খেয়েছেন যে তাকে কেউ চেনে না তা বলা যাবে না। তিনি নতুন গজিয়ে ওঠা দলের নেতা নন। কিংবা এমন কোনো অখ্যাত দলের সভাপতি নন। তার দল নিয়ে , তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা আলোচনা হয়েছে। নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন ভিপি নূর। তাহলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য যারা তাকে বেধরক পিটিয়েছেন তারা কি তাকে চিনতে পারেননি? হয়তো চিনেছেন বা চিনতে পারেননি। একজন রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্টকে এভাবে পেটাতে হবে কেন? এরা তো সরকারের বিরোধী আন্দোলন করছিল না।

ঘটনার পর সরকার এখন তদন্ত কমিটি করছেন। এর আগেও জাতীয় পার্টি  ও এনসিপির মধ্যে সংঘর্ষ  হয়েছে। ওই সশয় এনসিপির নেতাকর্মরা জাতীয় পার্টির কার্যালয় ভাংচুর করেছে। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তখন এনসিপির সদস্যদের নিরাপত্তা দিয়েছেন। এবার যখন গণঅধিকার পরিষদ জাতীয় পার্টির নিষিদ্ধের দাবিতে দলটির কার্যালয়ের সমানে কর্মসূচি ঘোষণা করে তখন সরকারের কী উচিত ছিল না সতর্ক থাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সংঘর্ষের আশঙ্কায় ১৪৪ ধারাও তো জারি করা যেতো।

কাকরাইলের ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার মুখে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তির একজায়গায় বলা হয়েছে, “সকল ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সরকারের এই সিদ্ধান্ত পুনর্ব্যক্ত করছে এবং জনমনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা আনয়নে সকল ধরনের মব ভায়োলেন্সের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে সদা প্রস্তুত রয়েছে। জননিরাপত্তা, আইনশৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখতে সেনাবাহিনী সর্বদা বদ্ধপরিকর।” “এছাড়াও বিজয়নগর, নয়াপল্টন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সাধারণ জনগণের চলাচল মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং জনদুর্ভোগ বৃদ্ধি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শান্তিপূর্ণ সমাধানের সকল চেষ্টা তারা অগ্রাহ্য করে। ফলস্বরূপ, জননিরাপত্তা রক্ষার্থে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বল প্রয়োগে বাধ্য হয়,” উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচজন সদস্য আহত হয়েছে বলেও দাবি করেছে আইএসপিআর।

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি ও সাবেক ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলাকে একটি সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের অংশ বলে উল্লেখ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।  তিনি বলেছেন, জাতীয় পার্টির নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। আইনগতদিক যাচাই -বাছাই করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কথা হচ্ছে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধে মব করতে হবে কেন? আর মব কি রাজনৈতিক দল করে?

নুরুল হকের স্বাস্থ্যগত অবস্থা এতটাই নাজুক যে চিকিৎসকরা এখনো তাকে আশঙ্কা মুক্ত বলতে পারেনি। এপরিস্থিতিতে সরকার তদন্ত কমিটির কথা বলেছে। আসলে সরকার এখানে কি তদন্ত করবে। নূরকে কে পেটালো সেটা? নাকি কী কারণে পেটালো সেটা। নাকি নুরকে পিটিয়ে জাতীয় পাটিকে নিষিদ্ধের দাবি থেকে দমনে চেষ্টা হয়েছে।

রাজনৈতিক নেতাদের ওপর পুলিশ প্রশাসনের আচরন বিগত সরকারের সময়ে বেশ সমালোচিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে এখনো যদি পুলিশ প্রশাসন বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর সেই ভুত জেকে বসে থাকে তবে সেটা আগামীর বাংলাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। যে শান্তির প্রত্যাশায় আমরা আছি, যে শান্তির জন্য প্রায় ১৪০০ মানুষ জীবন দিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানে সেটা ,সেটা ম্লান হয়ে যাবে।

Comments (0)
Add Comment