“ফ্রন্ট লাইন সোলজার”। সামরিক পরিভাষায় বলা হয় সম্মুখ সারির সশস্ত্র বাহিনীর কর্মীকে। বিশেষ করে যুদ্ধের ময়দানে যারা সবার আগে এগিয়ে চলেন। বিশ্বজুরে করোনা ভাইরাসের বিস্তারের পর এই শব্দগুলো বেশ জোরালোভাবেই আমাদের সামনে এসেছে । তবে যাদের উদ্দেশ্যে এসেছে তারা মরণাস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষের জীবন নিতে নয়, বরং জীবন বাঁচাতে মরণপণ লড়াই করেন। বর্তমান বিশ্বে ফ্রন্ট লাইন সোলজার একজন চিকিৎসক। যিনি মহামারিতে আক্রান্ত হবার শতভাগ সম্ভাবনা নিয়েই রোগীদের পাশে ছিলেন, আছেন।
আচ্ছা , করোনা পরিস্থিতি না হয় বাদই দিলাম। স্বাভাবিকভাবে একজন চিকিৎসক তার রোগীর চিকিৎসা দেন। সেটা দিন কি রাত। কখেনো অভিনন্দন পান, কখনো তিরস্কার। অর্থাৎ রোগী সুস্থ্য হয়ে উঠলে রোগীর আত্মীয় স্বজন বলেন খুব ভালো ডাক্তার। আবার রোগী সুস্থ্য না হলে বলেন, কি ডাক্তার হইছে।
পরিস্থিতি যেমনই হউক একজন চিকিৎসক একজন রোগীকে সুস্থ্য করে যে আনন্দ পান তা ওই রোগীর বা রোগীর আত্মীয় স্বজনদের সন্তুটির চেয়ে অনেক বেশি। আবার রোগীকে সুস্থ্য করে তুলতে না পারলে কষ্ট টাও অন্য সকলের চেয়ে বেশি? যে অনুভূতি আমরা সাধারণ চোখে দেখি না।
কিন্তু এই যে চিকিৎসক তারও তো রোগ শোক, ভালোলাগা , ক্লান্তি আছে। তার সম্পর্কে আমরা কতটুকু আন্দাজ করতে পারি।
ডা. মিমি হোসেন। রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের অ্যাসিসটেন্ট রেজিস্টার ইন কার্ডিওলজি । তার প্রাত্যেহিক জীবনে রোগীর সাথে যুদ্ধের একটু অনুভূতি শেয়ার করেছেন ফেইসবুক পেজে। তার অনুমতির সাপেক্ষে পুরোটাই তুলে ধরছি।
‘The most unpredictable place in this world is CCU…’

ডা. মিমি হোসেন
নাইট সিফট খারাপ ছিলো আজ, আক্ষরিক অর্থে খারাপ যাকে বলে। যতটা না শারীরিক পরিশ্রম ছিলো তার চাইতে ছিলো মানসিক স্ট্রেস প্রচণ্ড রকমের। দুটো লাইফ সাপোর্টের পেশেন্ট, দুটোই প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি, তাদের ম্যানেজ করা তার উপর ছিলো এই পেশেন্টদের সন্তান পরিজনকে কাউন্সেলিং এবং তা প্রায় মাঝরাত অবধি। শেষ রাতে নতুন পেশেন্টের আগমন। ডিউটি আওয়ার ষোলআনা খারাপ ছিলো কাল।
ভোরের কিছুটা সময় টেবিলেই হাত পেতে কিছুটা ঝিমিয়ে নিলাম, আমি আর আমার সহকর্মী ডা. বিন্তি। প্রচণ্ড সিনসিয়ার আর লক্ষ্মী একটা মেয়ে। সারারাতের যুদ্ধে দুজনেই ক্লান্তি নিয়ে পরের সিফটের ডা. এর অপেক্ষায় ছিলাম, রিলিভ হবার জন্য।
পুরো টিম যখন সিফট হবার অপেক্ষায় ঠিক তখন গোঙানির শব্দ পেলাম, সাথে সিস্টারের ডাক। একটা লম্বা সময় CCU তে কাজ করার কারণে আর খুব সামান্য অভিজ্ঞতার কারণে পেশেন্ট না দেখেও শব্দ ঠাহর করে অন্তত বুঝতে পারি যে রুগীর কি হয়েছে।
যথারীতি দৌড়ে বিছানার কাছে গিয়ে দেখলাম পেশেন্টের চোখ উলটে গেছে আর মনিটর শো করছে VT ( ventricular tachycardia).
সারা রাতের ভেতর অন্যান্য খারাপ পেশেন্টদের মাঝে তুলনামূলকভাবে অতটাও খারাপ এই পেশেন্ট ছিলো না, কিন্ত ঐ যে প্রথমেই বললাম, পৃথিবীর সবচাইতে unpredictable জায়গার ভেতর CCU একটি, তাই এমনটা হতেই পারে।

মুহূর্তের ভেতর Defibrillator করলাম, পেশেন্ট cardiac arrest এ চলে গেলো, সর্বসাকুল্যে ৭/৮ সেকেন্ডের একটা CPR দেয়ার সাথে সাথে আমার কিছুদিন যাবত হাতের ব্যাথার চুড়ান্ত কর্ম সারা হয়ে গেলো। আমি অন্য একজন কে দায়িত্ব দিয়ে সরে গেলাম। পেশেন্ট reverse back করলো। কিছুক্ষণ পর তাকিয়ে সাড়াও দিলো। আমি বাড়ি চলে আসা পর্যন্ত পেশেন্ট কে conscious দেখে এসেছি।
গত কিছুদিন যাবত আমার শোল্ডার জয়েন্ট এবং আর্মে প্রচন্ড ব্যথা, ব্যাথার ভয়াবহতা প্রকাশ করতে যদি উদাহরণ দেই তবে তা এমন যে, আমি দরজার নব ঘুরাতে পারিনা, ওয়াশরুমে গেলে পুশ শাওয়ার হ্যাং করাতে হাত পেছনে নিতে পারিনা, একটা এক লিটারের পানির বোতল তুলতে পারিনা, সর্বোপরি বিছানা থেকে উঠতে নামতে আমার নাভিশ্বাস উঠে যায়।
আপাতত কোনো ব্যথানাশক ওষুধ কাজে দিচ্ছেনা।
নিজের ব্যথার গল্প এই মৃতপ্রায় পেশেন্টের গল্পের সাথে জুড়ে দিলাম কারণ, বাইরে থেকে যারা ভাবেন যে আমরা একজন পেশেন্টকে বাঁচাতে যুদ্ধ করি না গল্পটা তাদের জন্য। আমরা নিজের ব্যথার কথা ভুলে যাই পেশেন্টকে বাঁচাতে, তাই আগ বাড়িয়ে ছোট করে বুঝানো যে, এমন অনেক অনেক কষ্টের মুহূর্ত থাকে আমাদের, যা আমরা ইগ্নোর করি অথবা সাময়িক ভাবে ভুলে যাই কারণ আমাদের মাথায় তখন শুধু একটা ব্যপারই থাকে, যেকোনো মূল্যে জীবন বাঁচানো।
আমার ছোট বোন কাম কলিগের একটা ডেস্পারেট গল্প বলি এই সুযোগে। আমি যাকে আমার সোল মেট বলি সেই টুম্পা নিজের ফুল টার্ম প্রেগন্যান্সির সময় ঠিক এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলো, পেশেন্ট কে CPR দেয়ার সময় তার মনে ছিলো না যে তার পেটে বাচ্চা। এবং যথারীতি এই ঘটনার পর তার leaking membrane ( পানি ভাঙা) হয়।
আমাদের এমন গল্প অনেক আছে, অনেক অনেক। যা হয়তো আপনাদের কাছে শুধুই গল্প কিন্তু আমাদের কাছে নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে অন্যের জীবন দেয়ার মতো মূল্যবান কিছু।
সেই মুহূর্ত টুকু আমাদের মাথায় পেশেন্ট ছাড়া আর কিছুই থাকে না। কিন্ত যখন পেশেন্ট মাথা থেকে বের হয়ে যায় তখন ব্যথাগুলো জানান দিয়ে যায় যে আমাদের ও ব্যথা আছে, আমাদের ও ব্যথা হয়, আমাদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়, পার্থক্য শুধু এই যে পেশেন্ট খারাপ হলে আমরা দায়ভার নেই কিন্ত আমাদের ব্যথার দায়ভার কেউ নেয় না।
but i am proud to be a saver a server and a DOCTOR…